চর কুকরি মুকরি সুখদেব দে (২৩/৭/২০১৪):ভোলা জেলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিঃ মিঃ দক্ষিণে সাগর কোলে উপকূল ঘেঁষে সবুজে সমারোহে ঘেরা, মনোমুগধকর এক দ্বীপ নাম তার চর কুকরি মুকরি। বঙ্গোপসাগরের তীরে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় জেগে ওঠা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এ দ্বীপ এখন ভ্রমণপিপাসুদের মিলন মেলায় পরিনত হয়েছে। এ দ্বীপের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেকোন পর্যটকদের মন সহজেই কেড়ে নেয়। তাই দ্বীপটি এখন প্রতিদিন শত শত দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত থাকে। জনশ্রুতিতে আছে, আজ থেকে প্রায় কয়েকশ বছর পূর্বে এ দ্বীপের জন্ম। সে সময়ে জনমানবহীন এ দ্বীপে কুকুর আর ইঁদুর ছাড়া আর তেমন কিছুই চোখে পড়তো না। এ অঞ্চলে ইঁদুরের আরেক নাম ছিল মেকুর। আর তাই এ দ্বীপটি পরিচিতি পায় চর কুকরি মুকরি নামে। এরপর কয়েক বছর ধরে পর্তুগীজ ও ওলন্দাজরা এখানে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে দ্বীপের বিভিন্ন অংশে নানা দস্যুপনা চালায়। ১৯৭৩ সালে বন বিভাগ চর কুকরি মুকরি এলাকায় বনায়নের কাজ শুরু করে। যা উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প হিসেবে পরিচিত। এ অঞ্চলে মূলত শ্বাসমূলীয় (কেওড়া) গাছের চারা রোপন করে বনায়নের কাজ শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে লাগানো হয় সুন্দরী, গেওয়া, পশুর প্রভৃতি নানা জাতের মূল্যবান বৃক্ষ। চর কুকরি মুকরি দ্বীপের প্রধান আকর্ষন হল এখানকার বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল আর তার সাথে পরিচ্ছন্ন সমূদ্র সৈকত। প্রায় ২০১৭ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত চর কুকরি মুকরি বন্যপ্রানী অভয়ারন্য এলাকা। পুরো অভয়ারন্যে রয়েছে, কেওড়া গাছের আধিক্য। এছাড়া বনে রয়েছে নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজি ও তরুলতা। অভয়ারন্যের আশেপাশের এলাকায় দেখা মেলে প্রচুর নারকেল গাছ, বাঁশ আর বেত বনের ঝোঁপ। কুকরি মুকরি দ্বীপের আরেকটি আকর্ষন হল এখানকার বিস্তৃন্ন বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য। এ বনভূমিতে রয়েছে- চিত্রা ও মায়াবি হরিণ, বানর, চিতাবাঘ, শিয়াল, বন বিড়াল (মেছো বাঘ), উদবিড়াল (ভোঁদড়), বন্য গরু-মহিষসহ আর নানা জাতের পশু। পাখিকুলের মধ্যে রয়েছে- নানা প্রজাতির বক, শঙ্খচিল, নানা রংয়ের মাছরাঙা, বনমোরগ, মথুরা, কাঠময়ূর, কোয়েল ইত্যাদি। এছাড়া সারা বছরই এখানে কমবেশি নানা সামুদ্রিক পাখির আনাগোনা থাকলেও শীতে পুরো দ্বীপটি পরিনত হয় পাখির মহারাজ্যে। কুকরি মুকরি অভয়ারন্যে, নানা জাতের সরীসৃপ প্রানীরও দেখা পাওয়া যায় এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গুঁইসাপ, কচ্ছপ, বেজি ও বিভিন্ন ধরনের সাপ।
এছাড়া এ দ্বীপের আশেপাশের জলাশয়ে পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রকারের অসংখ্য মাছ। আর তাই অভয়ারন্য এলাকার পাশেই দেখতে পাওয়া যায় ছোট ছোট জেলে পল্লীর। যারা নানা দূর-দূরান্ত থেকে এসে, এখানে বসতি গড়েছে। চর কুকরি মুকরির ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে একটি সরু খাল। যা ভাড়ানি খাল নামে খ্যাত। মেঘনার বুক থেকে বয়ে বনাঞ্চলের ভিতর অতিক্রম করে একে-বেঁকে খালটি, গিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। যেখনে রয়েছে ধু-ধু বালি আর সাগরের শোঁ শোঁ শব্দ। এখানকার চিক চিক বালি আর হালকা নীল জলরাশি যেকোন পর্যটকের কাছে সমূদ্র সৈকতে ঘুরে বেড়ানো সার্থক মনে হবে। একটু সামনে এগুলেই ঢালচর নামক আরেকটি আকর্ষনীয় দ্বীপ। স্থানীয় মানুষ এ স্পটটিকে বলে বালুর ধুম। তবে কুকরি মুকরির প্রধান আকর্ষন হল এর সাগরপাড়। যেখানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়। দীর্ঘ এ বালুকাময় বীচের একদিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ, স্নিগ্ধ বাতাস আর সাগরের আবিরাম গর্জন আবার অন্যদিকে রয়েছে ঘন সবুজ গভীর বন আর বনের জীববৈচিত্রের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। স্বপ্নের মত এ দ্বীপের শীতকালের চিত্র আবার অন্যরকম। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে ছুটে আসা, অতিথি পাখিদের আগমনে এখানকার চরাঞ্চলগুলো যেন নতুন রূপ ধারন করে। বিশেষজ্ঞদের মতে শীত মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় ৬৫০ প্রজাতির অতিথি বা পরিজেয় পাখি আসে। এর বেশির ভাগই ভোলা ও এর আশপাশের দ্বীপাঞ্চলগুলোতে অবস্থান নেয়। তখন কুকরি মুকরি দ্বীপটি, ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির অভয়ারন্যে পরিনত হয়। সে সময় পুরো কুকরি মুকরি দ্বীপাঞ্চল পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে। দেশের অন্যান্য দ্বীপগুলোর তুলনায় কুকরি মুকরির চিত্র কিছুটা ভিন্ন ধরনের। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কক্সবাজার, কুয়াকাটা আর সেন্টমার্টিনের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আর তাই স্থানীয় লোকজন চর কুকরি মুকরিকে মিনি সুন্দরবন হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে। তবে আর দেরি কেন, চর কুকরি মুকরি দ্বীপ থেকে আপনিও ঘুরে আসুন স্ব-পরিবারে বা স্ব-বান্ধবে। এজন্য প্রথমে আপনাকে যেতে হবে, ভোলা জেলা শহরে। এরপর ভোলা জেলা সদরের বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল বাস স্ট্যান্ড থেকে গাড়ীতে করে চর আইচা বাজারে নামুন। সেখান থেকে রিক্সায় করে চলে যান কচ্ছপিয়া বাজারের উপজেলা ট্রলার ঘাটে। ঘাট থেকে যেকোন ইঞ্জিন চালিত বোটে করে দু'ঘন্টার পথ পেরিয়ে সোজা চলে যান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি চর কুকরি মুকরিতে। কুকরি মুকরির সৌন্দর্য্য এখন শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় অনেক বিদেশী পর্যটকও এখানকার সৌন্দর্য্য উপভোগের জন্য ছুটে আসছে সুদূর পথ পেরিয়ে।
সরকার একটু সচেষ্ট হলেই চর কুকরি মুকরি হতে পারে, পর্যটকদের এক অপার আকর্ষন। আর এখান থেকে আয় করতে পারে প্রচুর পরিমানে রাজস্ব সাথে স্থানীয় লোকজনও খুজে পেত তাদের কর্মসংস্থানের নানান উৎস।