Blog
বিপ্লবী কমরেড নলিনী দাস
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যে কজন অগ্নিপুরুষ সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম কমরেড নলিনী দাস। তাঁর ৭২ বছরের জীবনকালের ২৩ বছরই কেটেছে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, হিজলী, আলীপুর আর প্রেসিডেন্সী কারাগারের বন্দীদশায়। দেশভাগের পর পাকিস্তানের কারাগারে পর্যন্ত বন্দী থাকতে হয়েছে এ বিপ্লবীকে।
জেল জীবনের বাইরে বাকি জীবনের ২০ বছর ৯ মাস তাঁকে থাকতে হয়েছে, আত্মগোপনে দুই বাংলার পথে প্রান্তরে।

ব্রিটিশদের রোষানলে পড়ে, তিনি জীবনভর কারাগার আর আত্মগোপনে থাকার কারনে সংসার জীবন থেকে সর্বদা দূরে ছিলেন। আবদ্ধ হতে পারেননি বৈবাহিক জীবনে। পারেননি মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও উচ্চ শিক্ষা নিতে।

www.bhola.waphall.com (nolini)
নলিনী দাস ১৯১০ সালের ১ জানুয়ারি ভোলা জেলার তৎকালীন উত্তর শাহবাজপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার বাবা দূর্গামোহন দাস ছিলেন ভোলার স্থানীয় জমিদারী এস্টেটের নায়েব। এ স্টেটের জমিদার ছিলেন কালীনাথ রায়। নলিনী দাসের প্রথম শিক্ষাজীবন শুরু হয় ভোলাতেই।
তিনি মাত্র ১২ বছর বয়সে কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। দুরন্ত চঞ্চল মেধাবী এই বালক ১৯২১ সালে কংগ্রেস ও খেলাফত কমিটির আহবানে হরতাল-ধর্মঘটের সময় পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্র থাকা অবস্থায় গ্রেফতার হন। একদিনের সাজা দিয়ে পুলিশ পরে তাঁকে ছেড়ে দেয়।
১৯২৪ সালে তিনি যুক্ত হন বিপ্লববাদী যুগান্তর দলে। পড়াশুনা আর দেশের স্বাধীনতার জন্য দৃঢ়চিত্তে শুরু হয় তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম। ১৯২৮ সালে তিনি সশস্ত্র বিপ্লববাদী দলের সাথে যুক্ত অবস্থায় প্রবেশিক (ম্যাট্রিক) পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। একজন ফুটবল খেলোয়ার হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি ছিল গোটা বরিশাল অঞ্চলে। এরপর তিনি বরিশালের বিএম কলেজে আইএসসি'তে ভর্তি. হন। আইএসসি পরীক্ষার পূর্বে তাঁর বিরুদ্ধে. কলকাতা মেছুয়া বাজারে, বোমা হামলার মামলায় গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী. করা হয়। শুরু হয় তাঁর পলাতক জীবন।

১৯৩০ সালে কলকাতায় পুলিশ কমিশনার টেগার্টকে হত্যার প্রচেষ্টা মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তাঁর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোন অভিযোগ না পাওয়ায় তিনি মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার তাঁকে প্রেসিডেন্সী কারাগারে, প্রেরণ করে। ১৯৩১ সালে, তাঁকে হিজলী ক্যাম্পে. পাঠানো হয়।

১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হিজলী ক্যাম্পে ব্রিটিশ পুলিশ অমানবিকভাবে রাজবন্দীদের উপর গুলি চালায়। ঐ সময় কলকাতার সন্তোষ মিত্র ও বরিশালের তারেকেশ্বর সেনগুপ্ত নিহত হন। আহত অবস্থায় নলিনী দাস ও ফনী দাসগুপ্ত হিজলী জেল থেকে পালিয়ে যান। আবার শুরু হয় পলাতক জীবন।

এরপর চন্দননগরের একটি বাড়ীতে নলিনী দাস, বীরেন রায় ও দিনেশ মজুমদার আশ্রয় নেয়। এর কিছুদিন পরেই এ ৩ জনের সাথে চন্দননগরের রাস্তায় পুলিশের সাথে চার ঘন্টা ব্যাপী এক বন্দুকযুদ্ধ বাধে। যুদ্ধে পুলিশ কমিশনার কিউ নিহত হয়। যুদ্ধ শেষে গ্রেপ্তার হন বিরেন রায়। চন্দননগরের ঘটনার পর বিপ্লবী নারায়ন ব্যানার্জীর তত্ত্বাবধানে নলিনী দাস, দিনেশ মজুমদার ও জগদানন্দ মূখার্জী আশ্রয় গ্রহণ করেন।
১৯৩৩ সালের ২২ মে পুলিশ ঐ বাড়ীটি ঘেরাও করে। শুরু হয় একখানি খন্ড যুদ্ধের। যুদ্ধে পুলিশের ডিএসপি পোলার্ড ও গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর মুকুন্দ ভট্টাচার্য আহত হন। একপর্যায়ে আহত অবস্থায় ধরা পড়েন তিন বিপ্লবী। ধরা পড়ার পূর্বে নলিনী দাস গুলি করতে করতে, ৩টি বাড়ীর ছাদ লাফিয়ে দূরে চলে যান। কিন্তু একপর্যায়ে শেষ হয়ে যায় তার সব গুলি, আহত অবস্থায় ধরা পড়েন তিনি।
এরপর তাদের বিচার শুরু হয়। বিচারে দিনেশ মজুমদারের ফাঁসি আর নলিনী দাস ও জগদানন্দ মুখার্জীর যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়ে আন্দামান সেলুলার জেলে পাঠানোর নির্দেশ হয়।

এরপর তাঁকে পাঠানো হয় আলীপুর জেলে। সেখানে তিনি বন্দীদের প্রতি বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিবাদে অসুস্থ থেকেও টানা ১৫ দিনের অনশন কর্মসূচি পালন করেন। তাই ব্রিটিশ সরকার কিছুটা বিব্রত হয়ে তাঁকে ডেঞ্জারাস বন্দী হিসেবে প্রেসিডেন্সী. জেলে পাঠান। ১৯৩৪ সালে তাঁকে পাঠানো হয় আন্দমান সেলুলার জেলে।

১৯৩৫ সালে আন্দামান সেলুলার জেলে দুজন কমিউনিস্ট নেতা- কমরেড আব্দুল হালিম ও সরোজ মুখার্জীকে রাজবন্দী হিসেবে, ধরে আনা হয়। এই দুই রাজবন্দী জেলে অন্যান্য বন্দীদের সাথে প্রতিদিন গোপন বৈঠকে অংশ নিত। এভাবে তাঁরা ১৯৩৫ সালের ২৬ এপ্রিল ৩৫ জন বন্দী বিপ্লবীদের নিয়ে একটি কমিউনিস্ট কনসলিডেশন গ্রুপ গঠন করেন। যে গ্রুপের মধ্যে নলিনী দাস ছিল সবচেয়ে বেশি আন্তরিক ও সকলের শ্রদ্ধার পাত্র।
সেসময় কমিউনিস্ট কনসলিডেশন গ্রুপটি দুনিয়ার খবর ও দি কল নামে হাতে লেখা দু'টি. পত্রিকা প্রকাশ করে। এর দায়িত্বে ছিলেন নলিনী দাস।

১৯৩৭ সালের সময়টা কাটে পড়াশুনা, সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রস্তুতি, বন্দী জীবনের বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম আর জেল থেকে মুক্ত হওয়ার নানা পরিকল্পনায়। নলিনী দাসের কঠোর প্রচেষ্টায় একসময় আন্দমানের প্রায় সকল বন্দী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়।

১৯৩৮ সালের ২৫ জুলাই পার্টির সকল বন্দী সদস্য নানা দাবীতে আমরণ অনশনের মত কর্মসুচি গ্রহণ করে। অনশনে ৩ জন বিপ্লবী মৃত্যুবরণ করায় ব্রিটিশরা কয়াকটি দাবি মেনে. নেয়। এরমধ্যে বন্দীদের পড়াশুনার সুযোগ অন্যতম।

কিছু দাবী পূরণ না হওয়ায় আবার আমরণ অনশন শুরু করেন কমিউনিস্ট মতাদর্শের বিপ্লবীরা। একপর্যায়ে সকল বন্দীরা এই অনশনে যোগ দেন।

চট্টগ্রামের সূর্যসেন আর ভোলার নলিনী দাস ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আতঙ্ক। তাই এই দুজনকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দেয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার ৫ হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষনা করে।

অগ্নিপুরুষ ভগৎ সিং, সূর্য সেন, বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম, দিনেশ মজুমদার, বিনয়, বাদল,রামপ্রসাদ, আসফাক উল্লা, ভবানী ভট্টাচার্য, গোপীনাথ সাহাসহ আর অনেকের মতো ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে নলিনী দাসকে, মারার চেষ্টা করে ব্রিটিশ সরকার ব্যর্থ হয়।
নলিনী দাসের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বিভিন্ন হত্যামামলার তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ার কারনে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে আন্দামান দ্বীপান্তর সেলুলার জেলে পাঠিয়ে দেয়। আন্দামান দ্বীপান্তর ছিল ব্রিটিশের তৈরি করা ২য় মৃত্যুফাঁদ। এখানে যাদের পাঠানো হত তারা কেউ আর ফিরে আসত না।

কিছুদিন পর নলিনী দাস আন্দামান দ্বীপান্তর জেলখানার সকল বন্দীদের নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে আমরন অনশন করেন। সে অনশন ৩৭ দিন স্থায়ী ছিল তাতে তিন বিপ্লবী মারা যায়। এতে ব্রিটিশ সরকার বেকায়দায় পরে যায়। তাই ব্রিটিশ সরকার অনেকটা বাধ্য হয়েই জেল কোর্ড আইন অনুসারে বন্দীদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ নিশ্চিত করে।

এরপর ১৯৩৮ সালের ১৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকার চাপের মুখে অনেকটা বাধ্য হয়ে আন্দামান বন্দীদের দেশে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু নলিনী দাসসহ ৩০ জনকে দেশে এনে তাদের মুক্তি না দিয়ে আলীপুর, দমদম, প্রেসিডেন্সী ইত্যাদি কারাগারে, পাঠানো হয়। এ সমস্ত জেলে নলিনী দাস রাজবন্দীদের নিয়ে পার্টির গ্রুপ গঠন করেন। একপর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার নলিনী দাসের অন্যান্য বন্দীদের সঙ্গে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তখন নলিনী দাস আন্দামান সেলুলার জেলের এক অনবদ্য ইতিহাস নিয়ে "দ্বীপান্তরের বন্দী" নামক একটি বই রচনা করেন। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। মূলত এ বইটি-ই ছিল ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক আন্দামানের নির্মমতার একমাত্র তথ্যবহুল ইতিহাস।

অবশেষে ১৯৪৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর নলিনী দাস মুক্তি পান।
দেশে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে কৃষক সমিতিকে গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

দেশভাগের পর তিনি এদেশ থেকে আবার নির্যাতনের শিকার হন। ১৯৪৮-৫০ সাল পর্যন্ত আত্মগোপন এবং ১৯৫০-৫৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান কারাগারে বন্দী থাকেন। কমিউনিস্ট আন্দোলনে অংশগ্রহনই ছিল তাঁর আপরাধ। ১৯৭১ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
এরপর ১৯৭২-৮২ সাল পর্যন্ত তিনি দেশ গড়ার কাজে সর্বদা নিজেকে সম্পৃর্ক্ত রেখেছিলেন।

জেল-জুলুম-নির্যাতন আর পলাতক জীবনযাপনের কারনে তিনি শেষ জীবনে মারাত্মকভাবে যক্ষ্মা. রোগে আক্রান্ত হন। ১৯৮২ সালে তাঁকে চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে। তাঁর অনুরাগী, বন্ধুবান্ধব ও আন্দামানের সহযোদ্ধারা চিকিৎসার জন্য তাদের সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যান।

চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর টাকার। তাই তাঁর হিতকাঙ্ক্ষিরা তাকে ভোলার পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রির পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখান করেন। তিনি সকল সম্পত্তি তাঁর বাবা দুর্গামোহন দাসের নামে একটি জনকল্যান ট্রাস্ট করে তাতে দান করেন।

এছাড়া, তাঁর সম্পত্তিতে ভোলায় এখন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, হোমিও প্যাথিক মেডিক্যাল কলেজের একটি ছাত্রাবাস, কিন্ডার গার্টেন ও পাঠাগার চলছে।

Www.bhola.waphall.com Nolini das2
কয়েক কোটি টাকার অর্থসম্পদ তিনি জনকল্যানের জন্য দান করে গেলেও তাঁর স্মৃতি শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম ফলকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
মহান এ বিপ্লবী ১৯৮২ সালের ১৯ জুন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।





U-ON
Bhola, Bangladesh
Home |
Back |
Top ^

Www.Bhola.Waphall.Com


Disneyland 1972 Love the old s